নাইজারের পর গ্যাবনে সেনা বিদ্রোহ আফ্রিকায় কী ফ্রান্সের শাসনের সমাপ্তি ঘটছে
গ্যাবন মধ্য আফ্রিকার একটি দেশ। ১৯৬০ সালে ফ্রান্স থেকে স্বাধীনতা লাভ করে
গ্যাবন। নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ এনে গ্যাবনের সেনাবাহিনী দেশটির শাসন ক্ষমতা
গ্রহণ করে। গত আগস্ট মাসে নাইজারের পর গ্যাবনে সেনা বিদ্রোহ ঘটে। এক মাসের মধ্যে
এটি আফ্রিকার দ্বিতীয় সেনা বিদ্রোহ।
ইউনিয়ন, কর্ম , ন্যায় বিচার এই তিনটি নীতিবাক্যকে নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় গ্যাবন
রাষ্ট্রটি। ফ্রান্সের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে গ্যাবন। আজকে আমরা গ্যাবন
সম্পর্কে জানব,গ্যাবনে সেনা বিদ্রোহ কোন প্রেক্ষাপটে এবং এই সেনা বিদ্রোহের ফলে
আফ্রিকায় ফরাসি উপনিবেশের কি প্রভাব পড়তে পারে সে সম্পর্কে জানব।
সূচিপত্রঃনাইজারের পর গ্যাবনে সেনা বিদ্রোহ আফ্রিকায় কী ফ্রান্সের শাসনের সমাপ্তি ঘটছে
- গ্যাবন সম্পর্কে খুঁটিনাটি তথ্য
- গ্যাবন এর ভৌগলিক অবস্থান
- গ্যাবনের সামরিক শক্তি
- নাইজারের পর গ্যাবনে সেনা বিদ্রোহ কেন
- গ্যাবনে সেনা বিদ্রোহ ফলাফল কি হতে পারে
- আফ্রিকায় কী ফ্রান্সের শাসনের সমাপ্তি ঘটছে
- আফ্রিকা এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি
- লেখকের মতামত
গ্যাবন সম্পর্কে খুঁটিনাটি তথ্য
চলুন আমরা প্রথমেই গ্যাবন সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে নেই:
- রাষ্ট্রীয় নাম- গ্যাবনীয় প্রজাতন্ত্র
- আয়তন- ২ লক্ষ ৬৭ হাজার ৬৬৭ বর্গ কিলোমিটার
- রাজধানী- ব্রাভিল
- জনসংখ্যা- প্রায় 22 কোটি
- ভাষা- ফরাসি
- জনসংখ্যার ঘনত্ব - প্রতি কিলোমিটারে ৮ জন
- মুদ্রা - সি এফ ফ্রাঙ্ক
- ধর্ম - খ্রিস্ট ধর্ম এবং ইসলাম
- সময় অঞ্চল- +১.০০ (ইউটিসি)
- ডায়ালিং কোড- +২৪১
- সরকার প্রধান- জেনারেল এন গুয়েমা
গ্যাবন এর ভৌগলিক অবস্থান
গ্যাবন মধ্য আফ্রিকার পশ্চিমে অবস্থিত রাষ্ট্র । এর উত্তরে
ক্যামেরুন
,পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগর, উত্তর-পশ্চিমে
বিষূবীয় গিনি
, দক্ষিণ ও পূর্বে
কঙ্গো প্রজাতন্ত্র
অবস্থিত।
গ্যাবনের সামরিক শক্তি
গ্যাবন সামরিকভাবে খুবই দুর্বল একটি দেশ দেশটির সেনা, নৌ , বিমানবাহিনী মিলে
সর্বসাকুল্যে মাত্র পাঁচ হাজার সক্রিয় সৈন্য রয়েছে । তাদের কোন রিজার্ভ সৈন্য
নেই। এছাড়া দেশটির পুলিশ বাহিনীতে অল্প সংখ্যক কয়েকজন সদস্য রয়েছে। তবে
দেশটির প্রায় দুই হাজার সদস্যের একটি রক্ষী বাহিনী রয়েছে যারা দেশটির
রাষ্ট্রপতিকে নিরাপত্তা প্রদান করে থাকে। দেশটির বর্তমান সরকার প্রধান জেনারেল এন
গুয়েমা এই রক্ষী বাহিনীর সাবেক প্রধান।
নাইজারের পর গ্যাবনে সেনা বিদ্রোহ কেন
গত ২৬ আগস্ট গ্যাবনের জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পরেই দেশটির
সেনাবাহিনী দেশটির ক্ষমতা দখল করে। আমরা যদি লক্ষ করি, গত মাসে নাইজারেও একই
রকমের ঘটনা ঘটে। দেশটিতে মূলত ফরাসীদের জুলুম নির্যাতনের বিরুদ্ধেই সেনাবাহিনী
বিদ্রোহ করে এবং জনগণ তাদের সমর্থন করে।
একইভাবে গ্যাবনের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট
আলী বঙ্গ ছিলেন ফরাসিদের কট্টর মিত্র। এই সুবাদে দেশটির তেল সমৃদ্ধ পশ্চিমাঞ্চল
নিয়ন্ত্রণ করত ফরাসিরা। পাশাপাশি দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে
হস্তক্ষেপ করত ফ্রান্স। ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট আলী বঙ্গ গত প্রায় পঞ্চাশ
বছর ধরে দেশটিতে ফরাসিদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে গেছেন।
ফলশ্রুতিতে দেশটি জনগণের মধ্যে তীব্র ফ্রান্স বিরোধী মনোভাব রয়েছে। দেশটির
সেনাবাহিনী মূলত এই বিষয়টিকেই কাজে লাগিয়ে দেশটিতে সেনা বিদ্রোহ ঘটিয়েছে।
সেনাবাহিনী ক্ষমতা গ্রহণের পর সাধারণ জনগন সেনাবাহিনীর সমর্থনে আনন্দ মিছিল
করেছে।
গাবনের বিদ্রোহের ফলাফল কি হতে পারে
গাবনে বিদ্রোহের ফলাফল খুব জটিল একটি সমীক্ষার মধ্যে দাঁড়িয়ে গেছে এখন।
যেহেতু এখানে পশ্চিমা রাষ্ট্র ফ্রান্সের স্বার্থে আঘাত লেগেছে সেহেতু ফ্রান্স
এবং তার পশ্চিমা মিত্ররা খুব দ্রুত হয়তোবা দেশটির উপর বিভিন্ন রকমের
নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে। পাশাপাশি দেশটিতে ফরাসি যে কোম্পানিগুলো রয়েছে
যারা দেশটির খনিগুলোর সাথে জড়িত তারা দেশটি ত্যাগ করতে বাধ্য হওয়ায়
গ্যাবন চেষ্টা করবে তার নিজের অর্থনৈতিক সামর্থ্য বৃদ্ধি করার জন্য।
কিন্তু পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে হয়তোবা তারা কাঙ্ক্ষিত সফলতা অর্জন করতে
নাও পারে। এখানে আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ নাইজারে সেনার বিদ্রোহের পর পশ্চিম
আফ্রিকার দেশগুলোর জোট ইকোয়াস নাইজারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেও
গ্যাবন এরকম কোন জোটের সদস্য না হওয়ায় এখন পর্যন্ত তারা যুদ্ধ ঝুঁকির
মধ্যে নেই ।
তবুও বলা যায় ফরাসিদের দীর্ঘ ৫০ বছরের মিত্র আলি বঙ্গ ক্ষমতা হারানোর ফলে
ফ্রান্সের স্বার্থে যে আঘাত লেগেছে তার ফলাফল স্বরূপ গ্যাবনে সেনা
বিদ্রোহ দেশটির জনগণের জন্য কি লিখে রেখেছে তার সময় বলে দেবে।
আফ্রিকায় কী ফ্রান্সের শাসনের সমাপ্তি ঘটছে
আফ্রিকার আঞ্চলিক রাজনীতি দিন দিন জটিল রূপ ধারণ করছে। আফ্রিকা মহাদেশের উত্তর
এবং পশ্চিমাঞ্চলে প্রায় এক শতাব্দী যাবত ফ্রান্সের একচেটিয়া আধিপত্য থাকলেও
সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় এটুকু দৃশ্যমান যে ফ্রান্স তার কর্তৃত্ব হারাতে বসেছে।
গত কয়েক মাসের মধ্যে মালি, বুরকিনা ফ্যাসো, নাইজারের পর গ্যাবনে সেনা
বিদ্রোহ।
এটি ফরাসী বিরোধী চতুর্থ বিদ্রোহ। প্রতিটি দেশেই এতদিন ক্ষমতায় ছিল ফরাসি
মদদপুষ্ট সরকার, কিন্তু দেশ গুলোর সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা এ সকল
স্বৈরশাসককে ক্ষমতাচ্যুত করার পরে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলে সকল দেশের সাধারণ
জনগণ নিজ নিজ দেশের সেনাবাহিনীর সমর্থনে আনন্দ মিছিল করেছে।
এ থেকে প্রতিয়মান হয় যে, আফ্রিকার কিছু দেশে এখনো ফরাসীরা থাকলেও গত দুই- এক
মাসের মধ্যে এ চারটি সেনা বিদ্রোহ তাদের সাম্রাজ্যে বিশাল রকমের ধ্বস নামিয়ে
দিয়েছে। এ সকল দেশ প্রতিটি কাগজে-কলমে দরিদ্র হলেও তারা প্রচুর খনিজ সম্পদের
সমৃদ্ধ কিন্তু ফরাসিদের কারণে তারা এতদিন পর্যন্ত নিজ দেশের সম্পদ নিজেরা ভোগ
করতে পারেনি ।
আফ্রিকা এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি
আফ্রিকার পরপর চারটি সেনা বিদ্রোহ যেরকম ওই মহাদেশের ফ্রান্সের রাজত্বে ধস
নামিয়েছে। একইভাবে এ সকল বিদ্রোহে পরোক্ষভাবে সমর্থন যুগিয়েছে রাশিয়া।
তুরস্কও চেষ্টা করছে আফ্রিকা মহাদেশের নিজস্ব কর্তৃত্ব স্থাপন করতে। এতদিন যারা
ফরাসিদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পায়নি তারা হঠাৎ করেই পরপর চারটি দেশে ফরাসি
সমর্থিত সরকারকে উৎখাত করেছে এটি কোন সাধারণ ব্যাপার নয়।
এ সকল দেশের সবার সামরিক শক্তি যদি এক জায়গাতে করা হয় তবুও তারা
ফ্রান্সের কাছে তাসের ঘরের মতো, তাহলে একটি প্রশ্ন আমাদের সবারই মাথায় আসে এ সকল
দুর্বল সামরিক শক্তির অধিকারী দেশ কিভাবে একটি পরাশক্তির বিরুদ্ধে মাথা তুলে
দাঁড়ালো??
এর সহজ উত্তর এ সকল বিদ্রোহে পরোক্ষভাবে সমর্থন ছিল রাশিয়ার। একটু লক্ষ্য করলে
দেখা যাবে এ সকল দেশের দীর্ঘদিন থেকেই রাশিয়ার ভাড়াটে যোদ্ধা বাহিনী ওয়াগনারের
উপস্থিতি রয়েছে। মালি থেকে যখন ফ্রান্স এবং জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীকে বের
করে দেওয়া হয় তখন সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করেছিল রাশিয়ান ওয়াগনার গ্রুপ।
তাই বলা যায় আঞ্চলিক আধিপত্য এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি হয়তোবা আফ্রিকা
মহাদেশকে ফ্রান্স এবং পশ্চিমাদের শাসন থেকে মুক্ত করবে অথবা পৃথিবীবাসি হয়তোবা
নতুন একটি যুদ্ধক্ষেত্র দেখতে পাবে কিছুদিনের মধ্যেই। কারণ যেখানেই
পশ্চিমাদের স্বার্থে ব্যাঘাত ঘটেছে সেখানেই তারা কোন না কোন অজুহাতে সামরিক
আগ্রাসন চালিয়েছে।
লেখকের মতামত
নাইজারের পর গ্যাবনে সেনা বিদ্রোহ কোন আকস্মিক ঘটনা নয়। মূলত ওই মহাদেশে
ফরাসিদের দীর্ঘদিনের শাসন শোষণের থেকে জন্ম নিয়েছে। আমরা আমাদের আগের
আলোচনায় নাইজারে সেনা বিদ্রোহের বিষয়ে আলোচনা করেছিলাম দুটি আলোচনা পড়লে
আপনারা বুঝতে পারবেন আফ্রিকায় পরপর সেনা বিদ্রোহের কারণ গুলো কি?
আজকে আমরা নাইজারের পর গ্যাবনে সেনা বিদ্রোহ কেন? এর ফলাফল কি? গ্যাবনের
সামরিক শক্তি আফ্রিকায় কী ফ্রান্সের শাসনের সমাপ্তি ঘটছে এবং আফ্রিকা মহাদেশের
ভৌগলিক রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করলাম। এরকম নিত্য নতুন বিশ্লেষণমূলক খবর পেতে আমাদের
ওয়েবসাইটটি নিয়মিত ভিজিট করুন ।ধন্যবাদ।।